১২ মে, ২০১৯ ১৫:০৬:৩১
সুস্ময় মুকুট ||
মোর কালারে-ওপারে ছকিলাম বাড়ী, তুই ক্যানে ডাকিলু নিশা রাইতেরে মুরুগা, বন্ধুয়া যায়রে ছাড়িয়া গাড়িয়াল, মনটায় মোর পিঠা খাবার চায়, তুই ক্যানে কান্দিসরে ভেলোয়া-পরিয়া শিমুলের ডালে, ১০১টা নামের পাত্রীর গান আরো অনেক জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া গানে কন্ঠ দিয়েছেন- ভাওয়াইয়ার রাজকুমার সফিউল আলম রাজা।
শৈশবে স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একটি গান গেয়ে সকলের নজরে আসেন।ছেলের গানে মুগ্ধ হয়ে বাবা মরহুম নজমুল হক যাত্রাপালা থেকে একটা ভাঙ্গা-পুরাতন হারমনিয়াম কিনে দেন।যেদিন হাতে পেলেন- সেদিন তার কি যে আনন্দ তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা ।বাজানোর ধরন দেখে বাবা মায়ের কি যে আনন্দ, খুশিতে আত্মহারা।এভাবেই বাবা মায়ের অনুপ্রেরণায় সফিউল আলম রাজার সংগীত জীবনের পথ চলা।
সংগীতে প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা গ্রহন করেননি এই শিল্পী।কাদা মাটির সোঁদা গন্ধ আর গাড়িয়ালের কন্ঠে গান শুনে শুনে তার বেড়ে উঠা। তবে ভাওয়াইয়ার কিংবদন্তি-গীতিকার,সুরকার এবং শিল্পী নুরুল ইসলাম জাহিদের কাছে তাত্ত্বিক বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছেন রাজা। প্রাইমারী গন্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে এসে তাঁর গানের দ্যুতি ছড়িয়ে পরে চারিদিকে।একবার এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে- মঞ্চের নেপথ্যে রাজা গাইছিলেন-ওকি গাড়িয়াল ভাই-হাকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে ।আর গানের সাথে মঞ্চত্ব হচ্ছিল- মঞ্চের এক কোনায় গাড়িয়াল গরুর গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে আর অন্য দিকে গায়ের বধূ কলসী কাকে নিয়ে উদাসপানে দাঁড়িয়ে আছে । গানটি শেষ হওয়ার সাথে সাথে বধুটির পানি ভর্তি কলসী হাত থেকে ফসকে পড়ে ভেঙ্গে যায় । গান,গাড়িয়াল আর গায়ের বধুর এক চমৎকার কম্বিনেশন।যারা অনষ্ঠানটি দেখেছেন-তারা নিশ্চয় আজো ভোলেননি ।
পারিবারিক দৈন্যতার কারনে ট্রেডেস হোমস ইন্টারন্যাশনালের স্কুল প্রোগ্রামে সংগীত শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন।সংগীতের পাশাপাশি সংবাদ পত্রে লেখালেখির কাজ শুরু করেন।এই লেখালেখির নেশা এতোটাই চেপে বসে যে,সব কিছু ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমান শিল্পী রাজা।
অনেক কাঠ খড় পোড়ে- সাংবাদিকতা জীবনের পাশাপাশি সংগীতটাকেও সমান তালে চালিয়ে যান তিনি।লোক সংগীতের অন্যতম ধারা ভাওয়াইয়া গানের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে শিল্পী রাজা ২০০৮ সালে রাজধানীতে “ভাওয়াইয়া গানের দল” প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন “ভাওয়াইয়া স্কুল”। যে স্কুলে ভাওয়াইয়ার উপর এক বছরের ফ্রি সার্টিফিকেট কোর্স করানো হয়। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারী সংস্কৃতির সকল শাখা নিয়ে রাজধানীর পল্লবীতে “কলতান সাংস্কৃতিক একাডেমী” প্রতিষ্ঠা করেন এই শিল্পী। তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরুষ্কার প্রাপ্ত চলচিত্র “উত্তরের সুর” এ চারটি মৌলিক ভাওয়াইয়া গান গেয়েছেন। শিল্পী জীবনে স্বীকৃতি স্বরূপ সফিউল আলম রাজা বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত বেঙ্গল বিকাশ প্রতিভা অন্বেষণে লোকসঙ্গীত বিভাগে (ভাওয়াইয়া নিয়ে) ২০০৬ সালে শ্রেষ্ঠ শিল্পী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। রাজধানীতে এ পর্যন্ত রাজা’র ৬ টি একক সঙ্গীতানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর উদ্যোগে ২টি, আঁড়িয়াল সেন্টারের উদ্যোগে একটি, আঁলিয়স ফ্রঁসেজের উদ্যোগে একটি, গুরুর চিকিৎসা সহায়তায় ‘ভাওয়াইয়া’ গানের দল-এর আয়োজনে একটি এবং ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে একটি একক সঙ্গীতানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে রাজার একটি মিক্সড অ্যালবাম এবং ভায়োলিন মিডিয়া থেকে ২০১১ সালে প্রকাশিত হয়েছে একক ভাওয়াইয়া অ্যালবাম ‘কবর দেখিয়া যান’। সংগীত নিয়ে সফর করেছেন অষ্ট্রেলিয়া, ভারত সহ বিভিন্ন দেশে। তিনি সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন রিয়েলিটি শোতে ‘বিচারক’ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
শিল্পী সফিউল আলম রাজা পেশায় একজন সাংবাদিক ছিলেন। দীর্ঘ ২৪ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে দৈনিক যুগান্তরে সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবে ১৪ বছরের বেশি সময় কাজ করেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি প্রিয়.কম-এর চিফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন।
এই শিল্পীর মৃত্যুর দায় তার একার নয়, গোটা সাংবাদিক সমাজের, আমাদেরও!
এক সময়ের তুখোড় সাংবাদিক রাজা কয়েক বছর আগে ডিআরইউর সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন করতে গিয়ে অন্যায় ভাবে যুগান্তর চাকরি ছাড়তে বাধ্য করেন। চাকরিটা হারালেও পাওনা টাকা বুঝে পাননি তিনি। সৎ সাংবাদিক হাসি মুখের রাজার হৃদয়ে এসব নিয়ে নীরব রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। যার চূড়ান্ত ফল হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু!